চার বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকার পর আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই সিলেট-ছাতক রেলপথের সংস্কার কাজ শুরু হচ্ছে। গত শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন ছাতক বাজার স্টেশন পরিদর্শন শেষে এই তথ্য জানান।
এই রেলপথের সংস্কার কাজ শুরুর খবরে স্থানীয়দের মাঝে আশার আলো জেগেছে।
বিগত সরকারের সময় একনেকে সিলেট-ছাতক রেলপথ সংস্কার কাজের প্রস্তাবনা পাস হলেও তা শুরু করা যায়নি। এবার সেই কাজে গতি দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে চলতি সপ্তাহে সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলনকক্ষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সেই সভায় এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এর আগে, সিলেট থেকে ছাতক হয়ে সুনামগঞ্জ জেলা সদর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের বিষয়ে সমীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন হলেও এরপর অজ্ঞাত কারণে সেই কাজে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
আরও পড়ুন: সংকটে জর্জরিত আলমডাঙ্গার রেলস্টেশন, নেই সংস্কারের উদ্যোগ
১৯৫৪ সালে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে পশ্চিম-উত্তরে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। ওই সময় জেলার রেলপথের সর্বশেষ স্টেশন হিসেবে ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়। তার আগে এটি আখাউড়া-কুলাউড়া-সিলেট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাথর, বালু, চুনাপাথর, কমলালেবু, তেজপাতাসহ বিভিন্ন মালপত্র আনা-নেওয়ার জন্যই মূলত ছাতক-সিলেট রেলপথটি নির্মিত হয়। পরবর্তী সময়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল পরিবহনে ছাতক-দোয়ারাবাজার অঞ্চলসহ সুনামগঞ্জ জেলার মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে প্রতিদিন এই রুটে সকাল-বিকাল যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করত। সিলেট যাতায়াতে ট্রেনই ছিল এই অঞ্চলের মানুষের একমাত্র ভরসা।
১৯৭৯ সালে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের রাজস্ব আয়ে ছাতক বাজার স্টেশন শ্রেষ্ঠ স্থান দখল করে নেয়। এরপর নানা অজুহাতে কমিয়ে দেওয়া হয় এই রেলপথে ট্রেন ও বগির সংখ্যা।
ছাতক থেকে ট্রেনে যাতায়াতে প্রায় ৪৫ মিনিটে সিলেট পৌঁছানো যায়। পথিমধ্যে খাজাঞ্চীগাঁও, সৎপুর ও আফজালাবাদ স্টেশনে ট্রেনগুলো যাত্রা বিরতি করে। শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত ছাতক থেকে চুনাপাথর, সিমেন্ট, স্লিপার, বালু, বোল্ডার পাথরসহ বিভিন্ন মালপত্র দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতে রেলপথে সড়ক পথের চেয়ে পরিবহন খরচ কয়েক গুণ কম হতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২২ সালে ভয়াবহ বন্যায় ছাতক বাজার স্টেশন থেকে সিলেট পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ১২ কিলোমিটার রেল রোড এমব্যাংকমেন্ট ও রেলপথ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপরই রেলপথটি পুনর্বাসন করে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করার জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়।
ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের সিলেট থেকে ছাতক বাজার সেকশন (মিটার গেজ ট্র্যাক) পুনর্বাসন প্রকল্পের একটি প্যাকেজের পূর্ত কাজের ক্রয় প্রস্তাবে সম্প্রতি অনুমোদনও দিয়েছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। প্রকল্পের কাজে ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করা হলে চারটি দরপত্র জমা পড়ে। দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে টিইসির সুপারিশ করা রেসপনসিভ সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মীর আখতার হোসেন লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২১৭ কোটি ৩৪ লাখ ৪ হাজার ৩৬৯ টাকা।
প্রকল্পটি একনেক থেকে ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল অনুমোদিত হয়। এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। প্রকল্প-ব্যয়ের ৮০ শতাংশ ডলার এবং ২০ শতাংশ বাংলাদেশি টাকায় পরিশোধ করা হবে।
শুরুর দিকে সিলেট থেকে ছাতক হয়ে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনে দুটি পথের বিষয়ে সমীক্ষা চালানো হয়।
সমীক্ষায় বলা হয়, ৪৫ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার অ্যালাইনমেন্টে টপোগ্রাফিক (ভূমি) জরিপের কাজ করা হয়েছে। এই রুটে আছে ৬৬টি ছোটবড় জলাভূমি। দক্ষিণ খুরমা ও শান্তিগঞ্জে দুটি স্টেশন নির্মাণ করতে হবে। রেলপথ নির্মাণের জন্য সরাতে হবে ১২৮টি বসতবাড়ি ও অবকাঠামো। এজন্য কাটতে হবে সাড়ে ১৩ হাজার গাছ। পাঁচটি স্টেশনের জন্য ৫০ একরসহ মোট ৬১৩ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
এমন জটিল হিসাব-নিকাশের মুখে প্রকল্পটির কাজ আর সামনে এগোয়নি।
ছাতক বাজার ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের সভাপতি আফসার উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, ছাতক-সিলেট রেলপথ বন্ধ থাকায় প্রতিদিন এই অঞ্চলের শত শত মানুষকে ভোগান্তি নিয়ে সিলেটে যাতায়াত করতে হচ্ছে। সুনামগঞ্জ রেলপথ স্থাপিত হলে জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে।
আরও পড়ুন: কক্সবাজারে বড় পরিসরে পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে ঝিনুক আকৃতির রেলস্টেশন
গুরুত্ব বিবেচনায় অতিদ্রুত রেলপথের কাজ শুরু করার দাবি জানান তিনি।
এদিকে, ছাতক-সিলেট রেলপথ সংস্কারের অনুমোদনের পর শুক্রবার বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন ছাতক বাজার স্টেশন পরিদর্শন করেন।
তিনি জানান, ফেব্রুয়ারি নাগাদ সংস্কার কাজ শুরু হবে। তবে সুনামগঞ্জে রেলপথ স্থাপনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান এ কর্মকর্তা।